গ্রীষ্মের দুপুরবেলা....
সারাদেশে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে।
ফজিলা বেগম তার মেঝ মেয়েকে নিয়ে ঢেকিতে ধান ভানছেন আর কথা বলছেন।
--- তাড়াতাড়ি কর শাহান, সময় নাই, পাকবাহিনী বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে।
---- আম্মা, পাক বাহিনী কি? এরা কি বড় বড় রাক্ষসের মতো? তুমি যে কিচ্ছা তে বলো?
ছোট মেয়ে সিমু এসে জিজ্ঞেস করলো। ও বারান্দায় পাশেই বসে খেলছিল।
----- দূর না, এরা ইয়া বড় বড় মানুষ, তবে শয়তান মানুষ, আমাদের দেশের মানুষ ধরে ধরে মারে আর সব কিছু নিয়ে যায়। ধান নাড়তে নাড়তে শাহান তার বোনকে বুঝাচ্ছে।
শাহানা এবার ক্লাশ ত্রী তে পড়ে। স্কুলের স্যারেরা তাদেরকে এসব বলেছেন। আর সিমু সবার ছোট, এখনও স্কুলে পা রাখেনি। ফজিলা বেগম পাঠশালা পাশ করেছেন। তাই পড়ার মর্ম বুঝেন। বড় মেয়ে সামিয়া এবার ক্লাস এইটে পড়তো, কিন্তু অভাবের জন্য ওর পড়া বাদ। আর অভাব থাকবে না কেন? কত্ত সুন্দর সংসার ছিলো, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা ধান, বাড়ির আঙ্গিনায় নানারকম শাকসব্জির ফলন।
অভাব পাশেই ঘেঁষতে পারেনি, কিন্তু হঠাৎ করে আলম সাহেব জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে, সব জায়গা, গহনা, বাড়ির গাছপালা, গরু বিক্রি করে পথের ফকির হয়ে গেলেন। এখন তিনি কোন কাজই করেন বা, ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু ৫/৬দিন থেকে কোন খবরই নেই, কেউ বলছে মুক্তিবাহিনী তে যোগ দিয়েছেন, কেউ বলছে পাকিরা ধরে নিয়ে গেছে।
ফজিলা বেগমের এসব ভাবার সময় নেই, তিনটে মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতেই তিনি হিমসিম খাচ্ছেন।
----- ও আম্মা, এখন ও হয়নাই চাল? ভাত বসাবো কখন?
ঘর থেকে ডাক দিলো সামিয়া।
--- এই হলো, নিয়ে আসছি তুই বের হোস না মা।
----- কি যে বলো না আম্মা, আমাদের বাড়িতে পাকিস্তানিরা আসবে না, দাও আমি চাল ঠিক করি" বলে ঢেকির সামনে এসে কুলা নিয়ে বসলো সামিয়া।
এমন সময় চারিদিকে গুলাগুলি চিৎকারের আওয়াজ আসলো। সামিয়াদের বারান্দায় ও তিনজন পাকিস্তানি সেনা এসে দাঁড়ালো।
---- লেড়কি তো বহুৎ খুবসুরত হ্যায়...
---- ওর বহুৎ কাচ্চা বি...
দুই পাকি সেনা বললো।
---- দোহাই লাগে সাহেব, আমার মেয়ের কোন ক্ষতি করবেন না সাহেব, আমার মেয়েটা অনেক ছোট, সাহেব দোহাই আপনার।
---- ইসকো ঘরমে রাখকে দরওয়াজা বন্ধ করো, হামি ইস লেড়কি কো দেখতাহু। বলে একজন সামিয়ার দিকে এগুলো।
ভয়ে আর বিমুড়তায় সামিয়া যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। ওদিকে বাকি দুই পাকি ফজিলা বেগম আর তার দুইমেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
---- দোহাই আপনাদের, আমার মেয়েকে কিছু করবেন না, আল্লাহ সহ্য করবেন না, আল্লাহর গজব পড়বে, ও আল্লাহ! তুমি আমার মেয়েকে রক্ষা করো। ভিতর থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছেন আর একটানা বিলাপ করছেন ফজিলা বেগম।
কিছুক্ষণ পর আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার শুনা গেলো। একটানা দশ পনের মিনিট চিৎকার আর্তনাদ এর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সামিয়া।
তারও অনেক পরে দরজা খুলে দিয়ে মানুষ নামক হায়েনারা চলে গেলো।
ফজিলা বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন, সমস্থ শরীর রক্তাক্ত, ঢেকিতে ধান গুলাও রক্তে রঞ্জিত হয়ে যেন এই নিষ্টুরতার সাক্ষি বহন করছে।
ফজিলা অনেক কষ্টে ওকে ধরে ঘরের ভিতর এনে শুয়ালেন, মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরালেন।
আর কাঁদতেই থাকলেন।
---- আম্মা, আমি মনে হয় বাঁচবো না, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, দুই উরু মনে হয় কেউ করাত দিয়ে চিরে ফেলেছে গো মা।
----- তোর কিচ্ছু হবে না রে মা, এভাবে বলিস না, আমি যে পাগল হয়ে যাবো রে মা।
----- আম্মাগো তুমি আমাকে মেরে ফেলো, ও আম্মা! আমি আর...... আবার ও প্রচন্ড যন্ত্রণায় সামিয়া জ্ঞান হারালো। আশে পাশের মহিলারাও এসে জমেছে তাদের ঘরে। একজন বুড়ো মহিলা, যিনি বনাজি ঔষধ করেন। তিনি গিয়ে কোথা থেকে গাছ গাছড়ার রস নিয়ে এসে ওর ছিন্নভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দিলেন।
এক সপ্তাহ পর... সামিয়া কিছুটা হাটতে পারছে, একরকম মৃত্যুর দোয়ার থেকে ফিরে এসেছে। এই কয়দিনে ফজিলা বেগম আর মেঝো মেয়ে শাহান মিলে রান্নাঘরে ধানের গোলার নিচে বাঙ্কার খুঁড়েছেন। হায়েনাদের বিশ্বাস নেই, ওরা আবার আসতে পারে।
দুপুরবেলা বাহিরে দুপদাপ আওয়াজ আর ফাঁকা গুলির শব্দ শুনে ফজিলা বেগম বড় মেয়ে আর মেঝোমেয়েকে তাড়াতাড়ি বাঙ্কারে ঢুকালেন, ছোটটা তখন বাহিরে পটি করছে বলে নিজেও ঢুকতে পারলেন না।
----- হেই আওরত, তোমহারি বেটিয়া কাহাহ্যায়?
---- সাহেব উসতো ঘরমে নাহি হে।
---- বকওয়াস বন্ধ করো, বুলাও উসকো।
না সাহাব, মেরি বেটি মরে যায়েগা সাহাব, রহম করিয়ে সাহাব। উনার মনে এইভাবে কথা বললে ওরা বুঝবে আর ছেড়ে দেবে, তাই ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি, উর্দু মিলিয়ে কথা বলছেন।
তখনই সিমু ঘরে এসে ঢুকলো আর একজন ওকে ধরে বললো।
--- বুলাও উসকো, নেহি তো তোমহারি এ বাচ্চা গেয়ি সমজোহ।
---- নাআআআআআ... ইয়া আল্লাহ! বলে ফজিলা ওইখানেই লুটিয়ে পড়লেন। তখন সামিয়া ধীরপায়ে বাঙ্কার থেকে উঠে আসলো।
----- আমার বোনকে, আম্মাকে ছেড়ে দাও। আমি এসেছি, যা করার করো।
----- না৷ মা, তুই যাসনে, তুই সহ্য করতে পারবি না মা, ওরা নিষ্টুর, হায়েনা, ওরা পশু.... আর কিছু বলার আগেই মাথায় ধড়াম করে বাড়ি পড়লো আর তিনি সেখানেই নেতিয়ে পড়লেন।
----- আম্মা! আমি বড় হতে চাইনা.. তুমি আমাকে ছোট করে রাখিও, নাহলে ওরা আপুর মতো আমাকেও মারবে, আর আমি কাঁদবো।
ফজিলা বেগমের জ্ঞান ফেরার পর সিমু তাকে এই কথাই বললো।
দীর্ঘ তিন চার মাস এই অত্যাচারের শিকার হতে হলো সামিয়া কে। নিজের মা বোনকে বাঁচাতে। একবার ওরা পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু পাকিদের হাতে ধরা পড়ে আবার ফিরে আসতে হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ.... সব গ্লানি, অত্যাচারের দিন ঘোছালো, বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হলো। কিন্তু সামিয়া? সামিয়া কি ফিরে পাবে তার ইজ্জত? তার সম্ভ্রম? বেচে থাকার অধিকার?
কোন এক আফগান কাবুলিওয়ালা সামিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হলো। কাবুলিওয়ালা জেনেও ওর বাবা মা বিয়েতে রাজি হলেন শুধুমাত্র স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। সামিয়া তখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর সেই কাবুলিওয়ালাও পালিয়ে গেলো হয়তো দেশান্তর হয়ে গেলো।
সামিয়া এই লজ্জা, এই মুখ কাউকে দেখাতে চায়না, রাতের অন্ধকারে সেও বেরিয়ে পড়লো অজানার উদ্দেশ্যে।
কোন এক দয়ালু মহিলা ফজিলাকে আশ্রয় দিলেন, একটুকরো জায়গাও ওর নামে করে দিলেন। সামিয়ার কোলে জন্ম নিলো স্বাধীন।
স্বাধীন এখন স্কুলে যায়, স্কুলের বাচ্চারা ওর সাথে মিশতে চায়না, স্যারেরা যেন কেমন করে থাকায়।
---- আম্মু, সবাই আমাকে পাকিস্তানি বলে কেন? পাকিস্তানি কি খুব পঁচা গালি?
------ না বাবা, তুই পাকিস্তানি না, ওরা বললে তুই বলবি, আমি বীর মায়ের সন্তান, আমি স্বাধীন, আমি পাকিস্তানি নামক হায়েনাদের কেউ না। সেলাই মেশিনে হাত চালাতে চালাতে সামিয়া স্বাধীন কে জবাব দিলো।
আরেকদিন দৌড়ে এসে স্বাধীন প্রশ্ন করলো, আম্মু আমার আব্বু কোথায়? সবার আব্বু আছে। সবাই বলে আমি নাকি জারজ, তাই আমার আব্বু নাই।
---- না বাবা, তোমার আব্বু আছেন, বিদেশে ব্যাবসা করতে গিয়ে মারা গেছেন।
---- আব্বু পঁচা, ওখানে মারা গেলেন কেন? দেশে এসে কেন মরলেন না?
---- আল্লাহ কার কখন মৃত্যু দিবেন কেউ জানেনা বাবা। আর কেউ কিছু বললে তুমি শুনিও না।
ছেলে এবার অষ্টম শ্রেণীর গন্ডি পেরিয়েছে। এ জায়গায় আর থাকা যাচ্ছে না লোকের কানাঘুষায়৷ তাই এইখানের জায়গা বিক্রি করে সব গুটিয়ে আবার নতুন জায়গার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো সামিয়া, যেখানে তার বাচ্চাকে কেউ কিছু বলবে না, যেখানে পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
তারপর.... তারপর ছেলে এখন বড় ব্যবসায়ী। ভালো জায়গায় বিয়ে করিয়েছে তাকে। আজকাল সামিয়া চোখে দেখেনা, হাটতেও কষ্ট হয়। কিন্তু ছেলের ঘরে আজ তার জায়গা নেই। ছেলের বউ সব জেনে বলেছে, কোন খারাপ পতিতার জায়গা তার ঘরে নেই। নাহলে ঘরে বরকত আসবে না, নামাজ রোজা হবে না। হয়তো অলক্ষে বসে একজন এসব কথা শুনেন, দেখেন আর হাসেন। হায়রে মানুষ আর হায়রে নিয়তি।
সামিয়া আজ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করে, যেখানে রাত হয় সেখানেই ঘুমিয়ে যায়। হয়তো কোনদিন এভাবেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে আর আজন্ম পাপ ধুয়ে মুছে পবিত্রতার স্বাদ পাবে। হয়তো তারজন্য ও স্বাধীন দেশের মাটিতে স্বাধীনভাবে শুয়ে থাকার জন্য সাড়ে তিনহাত জায়গা হবে। হয়তো...।
Comments
Post a Comment