কালো বোবা মেয়ে

 --- নিলু তোকে যখন চিমটি দেবো তখনই কবুল বলবি তার আগে না। মনে থাকবে তো?

---- আর কারও দিকে চোখ তুলে তাকাবি না, হাসবি না। ওরা গ্রাম্য লোক, না জানি কি ভাবে।
নিলুর মা আর বড়বোন নিলুকে ইশারায় কথাগুলো বুঝালেন। নিলু একবুক হাহাকার নিয়ে শুধু মাথা কাত করে হ্যা জানালো।
বরপক্ষের লোক ও এসে গেলো, মা বোনের শিখানো অনুযায়ী সে কবুল বললো। কাবিন আকদ ও হয়ে গেলো। বিয়ের অনুষ্ঠান ঠিক হলো আগামী মাসের পনেরো তারিখ। কাবিনের পর শাশুড়ি নিলুর পাশেই বসে আছেন।
---- বিয়াইন সাহেবা, আমার মেয়েকে কখনও কাজ করতে দেইনি, ওকে আস্তে আস্তে শিখিয়ে নিবেন। না পারলে কিছু বলবেন না, মেয়ে আমার বড় নাজুক।
---- কি যে বলেন বিয়াইন, আমার কোন মেয়ে নেই, বউমা আমার কাছে মেয়ের মতই থাকবে। আর এতো সুন্দর মেয়েকে কি কাজ করতে দিতে পারি?
কিন্তু দুইদিন পরই ফোন আসলো নিলুর শশুড়বাড়ি থেকে,
---আমাদের আরও একলক্ষ টাকা প্রয়োজন।
--- কি বলেন বিয়াইন সাহেবা? একলক্ষ টাকা তো দিয়েছি, ঘরের টাকাও দিলাম, ওদিকে ফার্নিচার ও কিনতে হবে, অনুষ্টান ও করতে হবে। এতো টাকা পাবো কই?
---- সেটা তো আমরা জানিনা, ঘর পুরা না করলে আপনার মেয়ে এসে থাকবে কই? ঘরের জন্য আরও টাকা লাগবে। আর আমাদের এসব শুনাচ্ছেন কেন? বোবা, কালা মেয়েকে যে ঘরে আনছি এটাই বেশি।
এসব শুনে নিলুর মা চুপ হয়ে গেলেন। রিনি বলে উঠলো "দিলে কি হলো মা, আমাদের নিলুই তো গিয়ে থাকবে। বলে দাও কাউকে পাঠিয়ে দিতে, আমরা টাকাটা দিয়ে দেবো।"
নিলুর পুরো নাম নিলুফা আফরিন সামিয়া। সবাই নিলু বলেই ডাকে, জন্ম নেওয়ার পর সবাই বলতো একটুকরো চাঁদ জন্ম নিয়েছে, দুধ সাদা গায়ের রঙ, মায়াবী চেহারা, কোকড়া চুল। যেই দেখতো সেই কোলে নিয়ে আদর করতো। ছয়মাসের সময় টাইফয়েড হয়ে সে বাকশক্তি ও শ্রবণশক্তি দুটাই হারায়। সেই সাথেই মনে হয় হারিয়ে যায় তার সকল স্বপ্ন, স্বাদ, আহলাদ।
নিলুর বাবা চাননি কেউ জানুক তার মতো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মেয়ে বোবাকালা। তাই ঘরের মধ্যেই শুধু নিলুর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়, সেই সাথে নিলু হাতের কাজ, নকশীকাঁথা, সেলাই সবই শিখে নিলো।
আস্তে আস্তে বড় হলো বুঝতে শিখলো, তখনই দেখলো সমাজে তারমত প্রতিবন্ধীর স্থান নেই। বড়বোন রিনির বিয়ে হলো এক প্রফেসর এর সাথে, চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ছোট ভাইবোনেরও বিয়ে হয়ে গেলো ভালো ভালো জায়গায়। কিন্তু তার বিয়ের প্রস্তাব!!
বিপত্নীক, প্রতিবন্ধী, এবং বুড়ো লোকদের কাছ থেকেই আসে। আর ভালো প্রস্তাব যা আসে ওর সবকিছু শুনে চলে যায়।
আজকাল ভাবীও কেমন অন্য চোখে দেখেন। বাবা তো সেই কবে, মারা গেছেন। আর মা, বোন চিন্তায় চিন্তায় বেহাল দশা হয়ে গেছে।
কখনও নিলুর মনে হয় মরে গিয়ে সবাইকে মুক্তি দেয় নিজেও মুক্তি পায়। কিন্তু মৃত্যুকে যে সে বড় ভয় করে।
অবশেষে গরিব ঘরের ছেলে জাহিনের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে নিলুর অমতেই।
যথারীতি বিয়েটা সম্পন্নও হলো।
গ্রামের সব মানুষ মেয়ে দেখে অবাক, "এতো সুন্দর মেয়ে জাহিনের মতো অকর্মা পেলো", "ইশ্ মেয়েটা যদি ভাল হতো ইউরোপ কান্ট্রিতে বিয়ে দিতে পারতো", বোবা মেয়েকে টাকার লোভে বিয়ে করিয়ে এনেছে।" আরও অনেক কিছু গ্রামের মানুষ বলাবলি করতেই থাকলো।
একসপ্তাহ পরই বেরিয়ে আসলো শাশুড়ির আসল রূপ।
সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে আটটার ভিতরে চা নাস্তা রেডি করা, আবার বারোটার ভিতরে দুপুরের খাবার রেডি করা, তাও লাকড়ির চুলায়, নিলু যেন কোন রোবট। বিকালবেলা একটু বিশ্রামের আশায় শুইতে পারেনা। আবার বাথরুমের পানি আনো, হাড়িপাতিল ধোও, লাকড়ি ঘরে আনো। যেন ফ্রিতে পাওয়া কোন দাসী।
দিনশেষে বিছানায় গা এলাতেই হতে হয় জাহিনের প্রয়োজনের সঙ্গী।
কাউকে বলতেও পারে না, মন থেকে বুঝাতেও পারেনা।
আবার কোন কাজে একটু ভুল হলেই শুনতে হয় ঝাড়ি, হাঁক, আর বাবা মা তুলে বিশ্রী ভাষায় গালী। কাউকে বলতে পারবে না, তর্ক করতে পারবে না। সুতরাং একে নাচাতে মজাই লাগে শাশুড়ি মার।
একদিন বিকালবেলা খারাপ লাগছিল বলে শাশুড়িকে ইশারায় বুঝালো একটু শুবে সে, উনি যেন বাহির থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আসেন।
শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি
--- নবাবের বেটি, আমাকে অর্ডার করিস? বোবাকালা হয়ে যদি অর্ডার করিস তাহলে ভালো হলে না জানি কি করতি!! মায়ের ঘরে সারা জীবন আরাম করে খেয়েছিস এটা আরামের জায়গা না, এখানে কাজ করে খেতেে হবে।
নিরবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কাজ করে যায় সে। সারাদিনের পরিশ্রমে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ঘুমাতে হয় আবার ব্যথা নিয়েই উঠতে হয়। জাহিন কখনও জিজ্ঞেস করে না, "কেমন আছো, খেয়েছিলে কি? বাড়ির কথা মনে পড়ে কি?"
একদিন সারাদিন খেলার পর জাহিন ঘরে ফিরলো। নিলুকে এসে জড়িয়ে ধরতেই নিলু বললো,
--- গোসলটা করে নাও, সারাদিনের ঘামে শরীরে গন্ধ হয়ে গেছে, তাছাড়া পশ্রাব করে পানি না নেওয়ায় আরও বিশ্রী গন্ধ হয়, তুমি কি জানোনা পশ্রাব করে পানি না নেওয়া মারাত্মক গোনাহ?
---- ভালো মন্দ আর গোনাহ শিখানোর তুই কে? মুখ আর কানের মতো নাকটাও চলে গেলে ভালো হতো। বউ হয়ে এসেছিস যেভাবে বলবো সেভাবে থাকবি।
---- আমি তো তোমার ভালোর জন্যই বললাম। দাঁড়িয়ে পশ্রাব আর পানি না নেওয়া শয়তানের কাজ। চোখভরা জল নিয়ে নিলু ইশারায় বললো।
---- আমার ভালো দেখতে হবে না, আমি যেমন আছি তেমনি তোর স্বামী।
আর হ্যা আমার সামনে মায়াকান্না কাঁদবি না।
একমাস পর জাহিন নিলুকে তার বাড়ি নিয়ে গেলো। নিলুর মনে হলে মরুভুমিতে প্রচন্ড তৃষ্ণার পর একফঁটা জল পেলো। নিলু ওর মাকে ধরে এতো কাঁদলো সারাজীবনে হয়তো কোন মানুষ এতো কাঁদেনি। নিলু মাকে আর বোনকে সব খুলে বললো, উনারা নিলুকে আর দিতে চাইলেন না। কিন্তু এতটাকা খরচ করে বিয়ের পর ভাই ভাবীর ঘাড়ে বসে সে খেতে চায়না। কিছু দায়ীত্ব এমনই নিতে না চাইলেও নিতে হয়, দায়ীত্বের টানে আবারও সে শশুড়বাড়ি নামক নরকপুরীতে এসে হাজির হলো।
নিলুর মাও অনেককিছু সাথে নিয়ে আসলেন। তিনি এসে নিলুর শাশুড়ি কে বললেন,
--- আমার মেয়ের মুখ থেকে এসব কি শুনছি? আমি কি এভাবে কাজ করানোর জন্য মেয়ে বিয়ে দিয়েছি?
---- কি বলেন বিয়াইন সাহেবা? কাজ কি? আমার ঘরে আর কি কাজ, আপনার মেয়ে শুধু চুলার সামনেই বসে।
---- সেতো দেখতেই পাচ্ছি ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে। আবার যদি এমন শুনি আমি মেয়েকে এসে নিয়ে যাবো।
---- আপনার মেয়ে মিথ্যা কথা বলছে, আমরা তো ভাবছি অনেক ভালো মেয়ে।
--- আমার মেয়ে ভালোই আছে, মিথ্যা আপনারা বলছেন।
তার কিছুদিন পর নিলুর শশুড়বাড়িতে মটর লাগিয়ে দিলেন যাতে নিলুর কষ্ট কম হয়। ঘর তো আগেই পাকা করে দিয়েছেন।
ব্যস হয়ে গেলো শাশুড়ির আরও একধাপ আগে এগিয়ে চলা, আরও বেশি বেশি পাওয়ার জন্য নির্যাতনের মাত্রা দিগুন হলো, জাহিনকেও অনেক কানপড়া দিয়ে বিষিয়ে তুললো নিলুর বিরুদ্ধে।
ইদানিং নিলু খেয়াল করেছে দেবর মাহিন তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে, বিনা অনুমতিতে রুমে যখন তখন ঢুকে পড়ে।
একদিন মাহিন তার গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করলে নিলু সবার সামনে সেকথা বললো।
শাশুড়ি বললেন,
--- বেইমান মেয়ে, মায়ের সাথে তালা তালি করেছিস আমার বিরুদ্ধে, আর এখন মাহিনের দোষ খুঁজে ভাইয়ের কাছে শত্রু করতে চাইছিস।
জাহিনও তাকে অবিশ্বাস করে চড় মেরে বসলো। সেদিন থেকে নিলুর জীবন আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো, যখন তখন জাহিন ওকে মারতে লাগলো, শাশুড়ির হাঁক, ভয় দেখানো, দেবরও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে ভয় দেখানো শুরু করলো।
তারপর একদিন সকালে ভয় পেয়ে এমন দৌড় দিলো যে কেউ তাকে ধরতে পারলো না, খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে, আর জাহিনকে ধরে বসে থাকে, শাশুড়িকে দেখলেই ভয়ে চিৎকার শুরু করে। এক সপ্তাহের ভিতর নিলু পুরো পাগল হয়ে গেলো। আর ওরা জীনের আছর হয়েছে বলে ওজা আর পীরের কাছে ওকে নিয়ে ছুটলো। কিছুতেই কিছু হয়না, নিলুর পাগলামি আর কমে না। নিলুর শাশুড়ি পাড়ায় বলে বেড়াতে লাগলেন, "পাগল মেয়েকে আমাদের কাছে গছিয়ে দিয়েছে ওরা, বোবাকালার সাথে সাথে মেয়ে পাগলও। ওদেরকে ঠকানো হয়েছে।"
নিলুর মা এসে ওকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। মানসিক ডাক্তার দেখিয়ে অনেক চেষ্টা, চিকিৎসা করিয়ে অবশেষে দুইমাস পর নিলু সুস্থ হলো। কিন্তু ভয়ে আর শশুড়বাড়ি আসতেই চাইলো না।
জাহিন স্বার্থের জন্য ভালোমানুষ সেজে শশুড়বাড়িতেই আসা যাওয়া করতে লাগলো। ওর আর ওর মার মনে ভাবনা কোনমতে ভালয় ভালয় জাহিনকে বিদেশ পাঠাতে পারলে আরও একটা বিয়ে করাবেন, সাথে আরও অনেক কিছু যৌতুক হিসেবে পাবেন।
একমাস পর জানা গেলো নিলু মা হতে চলেছে, এই আনন্দ কোথায় রাখবে। বহু প্রতীক্ষা আর কষ্টের পর সুখের মুখ দেখতে যাচ্ছে সে। নিলুদের বাড়ির সবাই খুশি। একমাত্র সন্তানই তার মাকে চিনতে পারে। সন্তানের কাছে মা তো মা-ই। না কোন বোবা না কালা।
শুরু হয়ে গেলো শশুড়বাড়ির মেকি ভালো অভিনয়। একসময় ওদের অভিনয়ের কাছে হার মেনে নিলুকে ওর মা শশুড়বাড়ি পাঠালেন। কিন্তু তার মাসখানিক পরই জানলেন নিলুর বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। এই বাচ্চা কে নষ্ট করলো? কারা দায়ী? তা সবার কাছেই অজানা রয়ে গেলো।
আর নিলু..? সে আবার আগের মতই পাগলী হয়ে গেলো। আবারও বাড়িতে এনে চিকিৎসা করতে হলো, কারন দায় যে সব নিলুদের, ওরা মেয়ের মা, বোন, ভাই। কিন্তু নিলুর ভালো হওয়ার কোন নামই নেই। ডাক্তার জানালেন অতিরিক্ত মানসিক টেনশন, ভয়, আর পরিশ্রমের জন্যই নিলুর এমন হয়েছে। প্রচুর বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো তখনও জাহিনের প্রয়োজন ফুরায় নি, নিলুকে ব্যবহারের জন্য তার আসা যাওয়া চলতেই থাকলো।
আবারও নিলু মা হবে... তবে আর সেই আগের মতো ভুল নয়, ভালো চিকিৎসা আর কেয়ারের মধ্যেই নিলুকে রাখা হলো। জাহিনকে চিরতরে বিদায় করে দিলেন নিলুর মা আর ভাই। ভিতরে বাচ্চার অনুভূতির ফলেই শেষ পর্যন্ত নিলু আবার ভালো হয়ে গেলো।
আজ নিলুর ছেলের একবছর পুরো হয়েছে। গুটিগুটি পায়ে হাঁটার পাশাপাশি মা মা ডেকে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ায়। নিলু কখনও মা বলে ডাকতে পারেনি, কিন্তু তার বাচ্চা তাকে মা ডাকে। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
বোবাকালা হয়ে কারও বুঝা হতে চায়নি সে, বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা সেলাইর দোকান খুলেছে, তার মতো আরও দুজন প্রতিবন্ধী মেয়ে সেখানে কাজ করে। জামা সেলাইর পাশাপাশি সে নকশীকাঁথা ও সেলাই করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। আর জাহিন? হয়তো তারমতো কেউ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কোন অন্ধকার গলিতে।
বোবারা সমাজের অভিশাপ নয়, ওরাও আমাদের মতো মানুষ, ওদেরও চাহিদা, সম্মান আছে নিলু তা সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল।

Comments