রঙ তার কালো পর্ব-৫

 তন্ময় তাহাকে বেডে শুইয়ে চামচ দিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে। তাহা ওর দিকে তাকিয়ে কথা না বলে চুপচাপ চোখের পানি ছেড়ে দিলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,

--- কেন এতো কষ্ট করছো আমার জন্য? কি লাভ হচ্ছে?বরং আমাকে আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি তো এমনিতেই বাঁচবো না।
---- প্রিয়তমা! তোমার পাশে থাকাই আমার চাওয়া, আমার এরচেয়ে বেশি কিছু লাগবে না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও।
ওর মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে তীক্ষ্ণ একটা তীর যেন তন্ময়ের বুকে বিঁধলো। যে মেয়ের মাথাভরা কালো চুল ছিল, যে চুলের সোঁদা গন্ধে সে হারিয়ে যেতো কোন অজানা রাজ্যে, সারাক্ষন মুখ গুঁজে থাকতো ওই চুলে। আজ সেই মেয়ের মাথায় একটা চুল ও নেই। চার মাস থেকে রেডিওথেরাপি আর কেমোথেরাপির কারনে সবগুলো চুল পড়ে গেছে। ওর শীর্ণ হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মুঠোয় পুরলো সে। চোখগুলো কোঠরে ঢুকে গেছে, গালের চামড়াগুলো হাড়ের সাথে লেগে গেছে, মনে হয় বিছানায় কোন কঙ্কাল শুয়ে আছে। কি ভেবেছিল আর কি হলো, চোখের সামনে জলজ্যান্ত আর হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটি মৃত্যুর দোয়ারে পৌছে গেলো। তাহার দিকে তাকিয়ে থেকে কখন যে অঝোর শ্রাবণ বয়ে চলেছে বুঝতেই পারলো না।
চোখ দিয়ে একফুঁটা পানি গড়িয়ে গিয়ে তাহার কপালে পড়লো। তাহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
-- তুমি কাঁদছো প্রিয়?
--- না না, আমি কাঁদছি না। তুমি ভালো মেয়ের মতো চুপটি করে ঘুমাও।
--- তুমি যাই বলো আমি সব বুঝি তন্ময়। তোমার জীবনটা নষ্ট করো না, আরেকটা বিয়ে করো।
--- তুমি কি জানো না আল্লাহ হতাশ হতে নিষেধ করেছেন?
পবিত্র কোরআনে আছে "নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীল দের সাথে রয়েছেন" (সূরা বাকারা:১৫৩)
মহানবী (সঃ) নারীদের বিষয়ে বলেছেন "তোমরা স্ত্রীদের জন্য মঙ্গলকামী হও"
(বুখারী৩৩৩১, মুসলিম ৪৭)
আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি প্রিয়তমা... যখনই মনে নিরাশা আর হতাশা গ্রাস করে তখনই এই আয়াত মনে করি,
নিরাশ হয়োনা, দুঃখিত হয়োনা, তুমিই জয়লাভ করবে যদি তুমি বিশ্বাসী হও"
(সূরা আল ইমরাম:১৩৯)
সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ কতো মহান।
বলতে বলতো তাহার দিকে তাকিয়ে দেখলো তাহা ঘুমিয়ে পড়েছে।
তন্ময়ের মা এসে প্লেট বাসন গুলো নিয়ে গেলেন। আর ঘুমিয়ে পড়তে বললেন।
হাসপাতালে একমাস থাকার পর তন্ময় বুঝলো তাহার জন্য সুস্থ পরিবেশ আর খোলা বাতাসের প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি ওর মন ভালো রাখার জন্য। তখন অনেক খুঁজে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর খোলামেলা পরিবেশের এই একতলা বিশিষ্ট বাড়িটি অনেকটাকা দিয়ে ভাড়া নিলো, বাড়িতেই তাহার সমস্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো। ওর ভাইয়েরা বাইরে থেকে তাহার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা পাঠাচ্ছে, তাছাড়া তন্ময়ের বাবা মা ও তন্ময়ের সাথে থেকে তন্ময়কে শান্তনা, সাহস আর তাহার সেবা করে যাচ্ছেন। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল তন্ময় এরা না থাকলে কি যে হতো তার। আপনজন আর আত্মীয়রা দুঃসময়ে কতো প্রয়োজন। তাইতো মহানবী (সঃ) বলেছেন "আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না।"
(আল হাদিস।

সকালে এসে নার্স তাহার প্রেসার আর বাকি সব চেকআপ করে গেলো। যাওয়ার সময় বললো, ডাক্তার বলেছেন আগামী ১১তারিখ উনার শেষ একটা বডি টেস্ট আছে, এটায় পজিটিভ রেজাল্ট আসলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ১০০% আর নাহলে ডাক্তারদের কিছু করার নেই।
--- আল্লাহ উত্তম ফায়সালাকারী।
ঝলমলে একটা দিন, আকাশে সূর্য মিষ্টি রোদ ছড়াচ্ছে, গাছে গাছে পাখিরা কলরব করছে। তন্ময় তাহাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাহিরে বাগানে এনে বসালো।
পাশে একটা চেয়ার নিয়ে তন্ময় ও বসলো। তন্ময় তাহাকে হাসির গল্প শুনাচ্ছে আর তাহা প্রচুর হাসছে। তন্ময়ের সেটা খুব ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কত যুগ পর তাহা একটু হাসছে। একটু পরে তন্ময়ের মা, ও বাবা এসে ওদের সাথে যোগ দিলেন।
---- কি হলো, আমার মামনি এতো হাসছে যে ব্যাপার কি? বসতে বসতেই তন্ময়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
--- দেখেন না বাবা কতকথা বলে আমাকে হাসাচ্ছে ও।
---- মা এই দুধটা আগে খাও, পরে হাসিও ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে তোমার।

এভাবে চলতে থাকলো কেয়ার ভালোবাসা আর যত্ন।
১১ তারিখের রেজাল্ট ও খারাপ আসলো তখন তন্ময় একেবারেই ভেঙ্গে পড়লো। এই নিয়ে তিনবার ব্লাড ট্রান্সফার করতে হয়েছে। এতো দ্রুত ব্লাড নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছেন শ্বেত কনিকাতে ভাইরাস টা ছড়িয়ে পড়ায় স্বাভাবিক কোষগুলো বাড়তে পারে না। এ তুলনায় ভাইরাস খুব দ্রুত বাড়ে আর কোষগুলো বড় হয় তখন অন্যান্য কোষগুলো আরও সংকুচিত হয়ে যায়।
তন্ময় এখন তাহার সেবা ছাড়াও সারাক্ষণ মসজিদে পড়ে থাকে। সারারাত নামাজ, তিলাওয়াত, কান্নাকাটি আর চিন্তায় সেও শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেলো। ডাক্তাররা শান্তনার জন্য নামমাত্র চিকিৎসা করছেন। তন্ময় আজকাল তাহার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। এতো অবনতির পরও মেয়েটার চোখ গুলো আশাতে চিকচিক করে জ্বলতে থাকে। তাহাই এখন তন্ময়কে শান্তনা দেয়।
আর বলে,
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সকল ব্যথিত ও চিন্তিত অন্তরকে ভালোবাসেন" (শুয়াবুল ঈমান)
নিজেই আশার বানী শুনিয়ে সবর করতে বলে,
"এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদেরকে দিবেন জান্নাত ও রেশমী পোশাক। (আল কোরআন, ৭৬ঃ১২)

আল্লাহ আরও বলেন, "নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে, অবশ্য কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে" (সূরা ইনসিরাহ: ৫-৬)

প্রহর যায়, দিন যায় মাস যায় তাহার অবস্থা আর ভালো হয়না। শুয়ে থাকতে থাকতে গায়ে পচন ধরে গেছে। এখন আর কথাও বলতে পারে না, শুধু অশ্রুভরা চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে, সেই চোখে বেঁচে থাকার আকুতি, ভালোবাসার আকুতি।
তন্ময় অসহায়ের মতে দাঁড়িয়ে থাকে আর চেয়ে চেয়ে দেখে, নিরব কান্নায় বুক ভাসায়। আজকাল রাতে আর তন্ময়ের ঘুম হয়না। বাবা মা ও ছেলের এই অবস্থা দেখে নিরবে চোখের জল ফেলেন।

একদিন ভোরবেলা জিকির পড়তে পড়তে বাগানে হাটাহাটি করছিল সে। চোখগুলো লাল হয়ে গেছে সারারাত জেগে থাকায়। করআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে দীর্ঘ মোনাজাতে কেঁদেছে। মনটা অনেক হালকা লাগছে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। "আল্লাহ তোমার মহিমা অসীম, ইয়া আল্লাহ! তুমি তোমার কুদরতি কারিশমা থেকে কিছু একটা করো আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওর হায়াত থেকে থাকলে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দাও, নাহলে তোমার সান্নিধ্যে নিয়ে যাও"
হাটছে আর বলছে।
বাগানে গাছে গাছে পাখি উড়ছে, ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, নানা রঙ্গের ফুল ফুটেছে যেন প্রকৃতিতে এক বিচিত্র রঙের মেলা বসেছে। দিগন্তের ও পারে যেন কুয়াশাগুলো ঝুলে রয়েছে, শিশির পড়ে ঘাস, গাছপালা ভিজে আছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র বৃষ্টি থামলো আর প্রকৃতি তার চিরসুন্দর সদ্য যৌবনা রূপ ধারণ করেছে। আজ কেন যেন যা দেখছে সব সুন্দর লাগছে। মন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে খুশির ফানুস। আজ তাহার রিপোর্ট আসবে ওর বডি উন্নতি বা অবনতি কোনদিকে যাচ্ছে না দেখে সবাই বিস্মিত, তাই ডাক্তাররা লাস্ট একটা টেস্ট করেছেন বিষয়টা বুঝার জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে যা হয় ভালো কিছু হবে, আল্লাহ তার বান্দাকে কোনকিছু না দিলে বুঝতে হবে সেই বান্দার জন্য উত্তম কিছু রেখেছেন, হয় ইহকালে নয় পরকালে।

দেরী হয়ে যাচ্ছে তাহাকে বাথরুম করিয়ে নাস্তা খাওয়াতে হবে। তাড়াতাড়ি তাহার রুমে গেলো কিন্তু দরজায়ই হা করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
একি দেখছে! তাহা নিজে হেটে বাথরুমে গিয়েছে!!
---- খুব বাথরুম পেয়েছিল, তুমি আসছো না দেখে নিজে চেষ্টা করে দেখলাম। শেষমেষ উঠতে পারছি, কি হলো হা করে আছো কেন? হাসিমুখে তন্ময়কে বললো। তন্ময় তখন ও হা করে আছে, নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে না পেরে সেখানেই নিচে বসে পড়লো সে। কতক্ষণ পর চোখ ডললো, নিজের গায়ে চিমটি কাটলো যখন সত্যি মনে হলো তখন চিৎকার করে বললো,
আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!! আল্লাহু আকবার! আল্লাহ তোমার মহিমা অসীম, জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদায় পড়ে গেলো। তারপর জোরে জোরে তার বাবা মাকে ডাকলো তাহাকে দেখে যাওয়ার জন্য।
--- বিশ্বাস করছো না তো? কয়দিন থেকে চেষ্টা করছিলাম নিজেকে তুলার, হাত পা নড়াচড়া করতাম শেষে আজ দাঁড়িয়েই গেলাম। ওর কাধে শুকনো হাতটা রেখে তাহা জবাব দিলো। তখন তন্ময়ের বাবা মা ও ঢুকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাহার দিকে। কলিংবেলের শব্দে সবাই সংবিৎ ফিরে পেলো।

ডাক্তার আর নার্স একসাথেই রুমে ঢুকলেন। ডাক্তার হাসিমুখে বললেন,
--- ইটস ইম্পসিবল! ইটস এ মিরাকেল!! আমরা ভাবতেই পারিনি এমন হবে, এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও ডাক্তারি অভিধানে নেই।
---- কি ব্যাপার ডাক্তার সাহেব? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?
---- নিন, রিপোর্ট দেখুন। তিনি তন্ময়ের দিকে রিপোর্ট এগিয়ে দিলেন।
কলিংবেল শুনে তন্ময় আর ওর বাবা ড্রইংরুমে এসে দরজা খুলে দেখলেন তাহার ডাক্তার আর নার্স রিপোর্ট নিয়ে আসছেন।
তন্ময় রিপোর্ট দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর হাসিমুখে বললো " সুবহানআল্লাহ! সব আল্লাহর হুকুম। আল্লাহ সবকিছু করতে পারেন, শুধু তার উপর বিশ্বাস আর ধৈর্য্য রেখে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।
"আল্লাহ কখনোই বলেন নি, 'হতাশ হও' কিংবা 'চেষ্টা ছেড়ে দাও'।
আল্লাহ বলেন, 'তুমি আস্থা রাখো আমার প্রতি'।"
সূরা: আল-ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
তাই আমার বিশ্বাস ছিল আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
--- আসলে বিষয়টা কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?
তন্ময়ের বাবা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন। ডাক্তার সাহেব উনাকে বুঝিয়ে বললেন,
--- এই পর্যন্ত আমরা যতবারই তাহার বডিতে ব্লাড ট্রান্সফার করেছি বডি তা একসেপ্ট করেনি, বরং খুব তাড়াতাড়ি রোগ প্রতিরোধ সেল মানে শ্বেত কনিকাকে ভাইরাসগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে, এমনকি হিমোগ্লোবিনে দ্বিগুন মাত্রায় ক্যান্সার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। কেমোথেরাপি ও কোন কাজ করেনি বরং আস্তে আস্তে অন্যান্য কোষগুলোকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিচ্ছু করতে পারিনি, তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, সব ঔষদ বাদ দিয়ে শুধু পেইনকিলার আর নরমাল ঔষধ দিচ্ছিলাম।
কিন্তু এই পনেরো দিন থেকে ওর বডি আশ্চর্য্যজনক মোড় নিয়েছে, আস্তে আস্তে ক্যান্সার ভাইরাস গুলা নির্জীব হয়ে যাচ্ছে, ব্লাডও বডি এপ্রোভ করেছে, এমনকি ওর বডি দ্রুত উন্নতির পথে এগুচ্ছে।
---- ডাক্তার সাহেব, তাই তো ও আজ হাঁটতেও পারছে!
--- কি বললেন?! সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ চাইলে কিনা করতে পারেন। অথচ আমরা ধরে নিয়েছিলাম আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে। চলুন তো দেখি গিয়ে...
তাহা তখন ওজু করে এসে শোকরানার নামাজ পড়ছিল। জায়নামাজে অনেক কান্নাকাটি করলো আল্লাহ তাকে দীর্ঘ ছয় সাতমাস পর নিজ শরীরে নামাজ আদায় করার তৌফিক দিয়েছেন।
ওরা তাহার নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে শেষে রুমে ঢুকলো।
তাহা এত লোককে একসাথে দেখে সালাম দিয়ে তাড়াতাড়ি ওর মুখে ঘোমটা টেনে দিলো। ডাক্তার সাহেব বৃদ্ধ মানুষ, উনি কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, মামনি এতদিন থেকে তো তোমার চিকিৎসা করে আসছি, তুমি আমার মেয়ের মতো পর্দা করার কি দরকার?
---- আঙ্কেল, প্রত্যেক নর নারীর উপর পর্দা ফরজ। আর মাহরাম ব্যতীত বাকি সবার সামনেই সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় পর্দা করতে হয়। আমি এখন সুস্থ, যে আল্লাহ আমাকে সুস্থ করে দিলেন তার আদেশ অমান্য করবো?
---- না মা, সত্যিই তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে, তাইতো তোমার উপর আল্লাহর এতো রহমত। আসো সাধারণ একটা চেকআপ করে ঔষদ লিখে দিচ্ছি, সুখবর হলো তোমার শারিরীক অবস্থা এখন নরমাল, বরং দ্রুত সুস্থ হচ্ছো।

সবাইকে কয়েকটা পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার বললেন, আমরা প্রতিদিন রুটিন চেকআপের জন্য আসবো রিপোর্ট লিখার জন্য, আর ওর কিছু রক্ত নিয়ে আমরা এই মিরাকেলের গবেষণা করবো।

রাতে বেলকনিতে তন্ময় তাহাকে নিয়ে বসলো।
তাহা ওর হাতে হাত রেখে বললো,
---তুমি আমার জন্য যা করেছো প্রিয়, পৃথিবীতে কোন স্বামী তার স্ত্রীর জন্য এমন করবে না। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেনো আমাকে তোমার প্রতি সকল দায়িত্ব পালন করার তৌফিক দেন।
---- তাই নাকি? আমি বেশি করে ফেলেছি?
---- হুমম, তুমি আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ট আর উত্তম স্বামী। তাহা ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বললো।
--- হুমম, প্রত্যেক পুরুষের উচিৎ তার স্ত্রীর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং উত্তম হয়।
রাসুল (সঃ) বলেন, "পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।"
(তিরমিযী :১১৬২)
বুঝেছো মহারাণী? তারা দেখা শেষ এখন তোমার ঘুম, ঠিকমতো খাওয়া, বিশ্রাম আর ঘুম চললে খুব তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ হয়ে যাবে, আগের মতো হয়ে যাবে। এখনকার মতো কঙ্কাল সুন্দরী থাকবে না।
---- কিহ্ আমি কঙ্কাল সুন্দরী ? এতোবড় সাহস তোমার?
--- এইরেহ, কাম সারছে, সুন্দরী আবার আগের রূপে ফিরে আসছে। আচ্ছা যাও কঙ্কাল হলেও তুমি আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী।
তারপর কোলে নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ালো। তাহাও আর কিছু না বলে তন্ময় কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
--- জানো তাহা, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বললে, ঝগড়া করলে অনেক ভালো লাগে। তুমি আমি সারাজীবন এভাবেই ঝগড়া করবো, ঠিকাছে?
--- হুমম ঠিকাছে!

তারপর কেয়ার, ভালোবাসা, আর চিকিৎসার পাশাপাশি বডি নিয়ন্ত্রনে থাকায় ছয়মাসের ভিতরে তাহা পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেলো।
ওরা সিলেটে ফিরে আসলো, তন্ময়ও তার ব্যবসা নতুন করে শুরু করলো।
তাহার অনুরোধে ওর শশুর শাশুড়ি ওর সাথেই থাকেন, এতে তাহার অনেক হেল্প হয়, শাশুড়ি তো ওকে কাজই করতে দেন না। বলেন, "এখনও সুস্থ হওনি মা, যখন সুস্থ হবে তখন আমিই তোমাকে কাজ করতে বলবো।" তাহার আম্মা আব্বাও কয়েকদিন পরপর ওকে দেখতে যান।
তাহা আর তন্ময়ের জীবন ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে গেলো। তন্ময় প্রতিনিয়ত আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে আর একটা কথা ভাবে,
"যে ব্যক্তি ধৈর্য্য ধারণ করতে পারবে,
সে কখনও সফলতা থেকে বঞ্চিত হবে না।
হয়তবা সফল হবার জন্যে তার একটু বেশি সময় লাগতে পারে।"
(হযরত আলী রাঃ)
একদিন অফিস থেকে ফিরে তন্ময় দেখলো তাহা শাড়ী পরে সাজগোজ করে বসে আছে। ও সেটা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
--- কি ব্যাপার? আমার প্রেয়সীর আজ হঠাৎ এতো সাজগোজ?
--- বারেহ্ আমি কি সাজি না নাকি?
--- না সাজো তো প্রতিদিন, আর প্রত্যেক মেয়ের উচিৎ তার স্বামীর জন্য সাজগোজ করা, আর স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের জন্য সাজগোজ করা হারাম। কিন্তু আজকের টা যেনো অন্যরকম, ঠিক যেনো লাজুক লতা।
অবশ্য বিয়ের পর তো তোমাকে লাজুক বউ দেখিনি, দেখেছি জল্লাদ মেয়ে হিসেবে। বাপরেহ, তুমি এত জল্লাদ জীবনেও ভাবিনি, সারাক্ষণ ভয়ের মাঝে রাখতে।
তাহা কিছু না বলেই কান্না শুরু করে দিলো।
---- আরেহ, কাঁদছো কেন? এখন তো তুমি আমার ভালো, মায়াবী একটা বউ। কত লাজুক লাগছে, আমার সারাজীবনের শখ ছিলো তোমায় লাজুক বউ হিসেবে দেখবো। আজ দেখে মনের আশা পূর্ণ হলো।
---- তুমি আমাকে সবসময় জল্লাদ বলো, আমি এমনিতেই আমার আগের কাজের জন্য অনুতপ্ত।
---- হুম্ম সেজন্যই তো তুমি আমাকে এখন এতটা ভালোবাসো। এখন বলোতো ব্যাপার কি? কিছু একটা তো আছেই।
---- হুম্ম, আমাদের নতুন অতিথি আসছে গো। লাজুক ভাব নিয়ে তাহা তন্ময় কে বললো।
তন্ময় কিছুক্ষণ বিমোড় হয়ে তাহার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুশিতে তাহাকে নিয়ে নাঁচতে শুরু করলো।
নামিয়ে রেখে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলো।
কারন একটা কথা মুমিন নরনারীকে মানতে হবে, "যখন তুমি খুশি তখন তুমি নিচে নেমে যাও, সেজদায় পড়ে যাও, ফিরো আল্লাহর কাছে, আবার যখন তুমি দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত তখনও তুমি উঠে দাঁড়াও, নামাযে দাঁড়াও ফিরো আল্লাহর কাছে।"
তন্ময় দৌড়ে বাবা মায়ের রুমে গেলো, তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলো। বাবা মা দুজনই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, তাহার কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখেন তাহা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, ওর ও চোখে জল আর মুখে হাসি।
--- তন্ময়, বাবা কান্না থামিয়ে বলবিতো কি হয়েছে?
---- আম্মু, আমি বাবা হতে যাচ্ছি আমি আজ সবচেয়ে বেশি খুশি আম্মু। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন আমি সারাজীবন এর কৃতজ্ঞতা আদায় করে শেষ করতে পারবো না।
--- আলহামদুলিল্লাহ! বউমা এদিকে এসো। কতো খুশির কথা আর তোমরা কান্নাকাটি করছো?
আমি সারাগ্রামের মানুষকে মিষ্টি বিতরণ করবো, তোমরা কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাও।
পরদিন তারা দুজনেই ডাক্তারের কাছে গেলো চেকআপ করে কনফার্ম হওয়ার জন্য।
কিন্তু ডাক্তার যা বললেন তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না।
উনি ডাইরেক্ট না করে দিলেন এখন বাচ্চা নেওয়া যাবে না। এইমাত্র তাহা মৃত্যুমুখ থেকে ফিরেছে, ওর এখন পূর্ণ বিশ্রাম আর প্রচুর খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজন, শরীরে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্লাড সাপ্লাই হচ্ছে না। আর যে বাচ্চা হবে তার জন্যও রিস্ক হয়ে যাবে। কিন্তু তাহা একদম মানতে নারাজ, ও বাচ্চা নষ্ট করবে না, জান দেওয়ার মালিক আল্লাহ, নেওয়ারও মালিক আল্লাহ। আল্লাহর হুকুমেই এতদিন এতো কিছু ঘটেছে, আর আল্লাহর হুকুমেই তারা ভালোবাসার উপহার পাচ্ছে, যা একটা পরিবারের খুশির কারন। সে এটা কিছুতেই করবে না। সবাই বুঝানোর পরও তাহা রাজি হলো না। শেষমেশ ডাক্তার বাধ্য হয়ে ট্রিটমেন্ট চেকআপ সব করতে রাজি হলেন, কিন্তু তাহার বা বাচ্চার কিছু হলে তিনি দায়ী নয় এই শর্তে।
তাহা বললো, "আমরা কাউকে দায়ী করিনা, করবোও না, যা তাকদীরে নির্ধারিত তা হবেই, শুধু আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।"

সারাদিন রাত তন্ময়রা তাহার কেয়ার করতেই থাকে।
তিনমাস পর যখন ওরা আবার চেকআপ করতে গেলো, তখন ডাক্তার অবিশ্বাস্য এক রিপোর্ট জানালেন।

Comments